সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৪:০২ অপরাহ্ন

যেভাবে রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া

যেভাবে রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া

স্বদেশ ডেস্ক:

তারা মিয়া (৭০) ছিলেন রাজাকার। সময়ের ব্যবধান আর সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হওয়ার পর ধীরে ধীরে অনেকটা আড়াল হয়ে পড়ে তার অপকর্ম। তবে বসে থাকেননি তিনি। ধুরন্ধর তারা মিয়া নিজের বাবার নাম গোপন করে অন্য একজনের নাম ব্যবহার করে বনে যান মুক্তিযোদ্ধা। আর সড়ক দুর্ঘটনায় আহতাবস্থাকে পুঁজি করে নাম লেখান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। এর পর তিনি ভোগ করেন সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা। অবশেষে গ্রেপ্তার হন তিনি।

ময়মনসিংহের ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ী ইউনিয়নের ইটাউলিয়া গ্রামের বাসিন্দা তারা মিয়াকে এলাকাবাসী জেনে আসছেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের জারি করা পরোয়ানামূলে

পুলিশ তাকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। এর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে উপজেলাজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেরই প্রশ্ন- কীভাবে এতদিন আসল পরিচয় গোপন করে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন এবং সুবিধা ভোগ করেন।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২১ অক্টোবর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া তারা মিয়ারা চার ভাই। তিনি ছাড়া অন্য তিন ভাই বাবার নাম হিসেবে শাহনেওয়াজ নামটি ব্যবহার করেন। একমাত্র তারা মিয়ার বাবার নাম ‘শমসের আলী’।

জানা গেছে, পাশর্^বর্তী গৌরীপুর উপজেলার ধোপাজাঙ্গালিয়া গ্রামে তারা মিয়া নামে ভাতাভোগী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। যার বাবার নাম শমসের আলী। ধুরন্ধর তারা মিয়া এ বিষয়টি জানতে পেরে তদ্বির করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় নাম উঠান। এর সুবাদে বাগিয়ে নেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারিভাবে নির্মিত বহুতল ভবনে চার কক্ষবিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট। নিজ গ্রাম ইটাউলিয়ায় সরকারিভাবে বরাদ্দ পান ১০ শতাংশ জমি। প্রতিমাসে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট হতে উত্তোলন করতেন ৩০ হাজার টাকা ভাতা। অত্যাধুনিক হুইল চেয়ারে করে তারা মিয়া পৌঁছে গেছেন বঙ্গভবন পর্যন্ত।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বাক্ষরিত ২০১৪ সালের ১ জুলাই ইস্যু করা এক পরিচয়পত্রে তারা মিয়ার নাম যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে তারা মিয়ার স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের দাবি, তার স্বামী নির্দোষ এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। পড়ন্ত বয়সে তিনি কথা বলার শক্তিও হারিয়েছেন, তার পরও পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে।

তারা মিয়ার ছেলে আবুল কালাম বলেন, স্থানীয় একটি চক্র আমার আব্বার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করেছে।

এ ব্যাপারে আঠারবাড়ী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার রঞ্জন ঘোষ বলেন, তারা মিয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। পাশের উপজেলার এক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ও বাবার নামের মিল থাকার সুযোগে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হন। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাছিমপুরের লতিফ মাস্টারকে প্রকাশ্যে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া পাকবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ঘেরাওয়ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তার। আমরা যখন জানতে পারি সে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার পর একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একাধিকবার প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে একজন রাজাকার অনেক কিছুই করেছে। তাকে বঙ্গভবনেও যাতায়াত করতে দেখেছি। সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তারা তারা মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সত্যতা পেয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কো-অর্ডিনেটর সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রহিম বলেন, আমি ২০১৭ সালে ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি ছিলাম। ওই সময় তারা মিয়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়- মর্মে আমরা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলাম। সর্বশেষ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877